Top Ad unit 728 × 90

>
[]

কুসংস্কার : গোরস্থানে সাবধান!

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পুতুল নাচের ইতিকথায় বলেছিলেন, “গ্রামের লোক ভয় করিতে ভালোবাসে। গ্রামের বাহিরে খালের এপারের ঘন জঙ্গল আর গভীর নির্জনতাকে তারা এই কাজে লাগাইয়াছে।” আসলে ভয় বাঙালীদের যুগ-যুগন্তের মরণ নেশা। তারা অতিপ্রাকৃত শক্তির তত্ত্বটা মেনে নিয়ে বদ্ধ ঘরে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে, কিংবা আখড়া জমিয়ে ভয়ের কলকেয় সুখটান দেয়।
খুব ছোট বেলা থেকেই আমি ভৌতিক ব্যাপার-স্যাপারগুলোর ঠিক বিশ্বাস করি না। সংস্কারের ভয় দেখিয়ে সেগুলো করতে নিষেধ করা হত, লুকিয়ে লুকিয়ে সেগুলোই বেশি করে করতাম। পরে দেখতাম, আমার বিশ্বাসই ঠিক। ভয় দেখানোর জন্য বড়রা ওগুলো করতে নিষেধ করে। অবশ্য একেবারে বিনাকাজে নয়। কিছু ভয় দেখানো হয় দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য।
আগেই বলেছি, ভৌতিকতায় আমার অবিশ্বাসের কথা। বড় হয়ে যখন যূক্তিবাদী বইগুলো পড়া শুরু করলাম, তখন অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তরও বেরিয়ে আসতে শুরু করল। পরে অনেক কিছুর ব্যাখ্যা নিজে নিজেই করা শিখলাম। গোরস্থানের দুটো ঘটনাও ঠিক নিজের মত করে ব্যাখ্যা করতে শিখেছিলাম। আজ থাকছে সে দুটোরই বয়ান।
ভৌতিকতায় অবিশ্বাসী বলে অনেকেই নানা ভৌতিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সেগুলোর ব্যাখ্যা আমার কাছে চায়। গোরস্থানের ঘটনাগুলোও এর অন্যতম। অবশ্য আমি নিজেও দেখেছি।

প্রথম কথা, গোরস্থানে নাকি প্রায়ই কবরের আজাব দেখা যায়।
‘আজাব আবার দেখা যায় কীভাবে?’ প্রশ্ন কর্তাকে পাল্টা প্রশ্ন করি আমি।
‘মানুষে সে আজাব দেখতে পায় না। তবে অবলা প্রাণীরা নাকি তা দেখতে ও শুনতে পায়।’ বলে প্রশ্নকর্তা।
এই শুরু হলো তেনা প্যাঁচানো। যে সবকিছু খুলে বলতে পারে সে কখনো দেখবে না। কিন্তু যে কথাই বলতে পারে না, রাজ্যের অলৌকিকতা তার সামনেই ধরা দেয় বার বার।
শুধু কি ত্যানা প্যাচানোর জন্যই মানুষ এমনটা বলে, নাকি বৈজ্ঞানিক কোনও ভিত্তি আছে?
কিছুটা ভিত্তি তো আছেই। অবলা প্রাণী বলতে গরু আর কুকুরের উদাহরণ দেয়া হয় বারবার। গাঁয়ের গোরস্থানে কুকুর আর গরুদের অস্থির আচরণই মানুযকে ভয় পাইয়ে দেয়, ভুল বিশ্বাসের ভিত্তি মজবুদ করে। আগেই বলেছি, শুধু শোনা কথা নয়, কিছু ব্যাপার নিজেও দেখেছি। ছোটকালে মাঝে মাঝে গরু চরতাম আমি। কুকুর নিয়ে শিয়ালের পেছনে ধাওয়া করার অভিজ্ঞতাও আমার কম নয়। এই দুই প্রাণীকে দেখেছি, গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেমন যেন অস্থির হয়ে যায়। ছোটাছুটি করে। দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যেতে চায় গরু। ফোঁস ফোঁস করে গর্জায় কখনও কখনও। শুধু তা-ই নয়, দেখা যায় একটা গোরস্থানে শত শত কবর থাকে কিন্তু তার ভেতরে নির্দিষ্ট একটা কবরের দিকে তেড়ে যায়। শিং দিয়ে গুঁতিয়ে কবরের মাটি আলগা করে ফেলে প্রবল আক্রোশে। যদি কবর রেলিং দিয়ে ঘেরা থাকে, তবে প্রবল বিক্রমে সেই বেড়া ছিন্ন ভিন্ন করতে পিছপা হয় না নীরিহ গরু। লোকে তখন ভাবে, কবরের ভেতরে যে মানুষটি শুয়ে আছেন, তিনি বড্ড পাপী ছিলেন, ভয়াবহ আজাব হচ্ছে তাঁর।
কবরের আজাব পশু-পাখিরা বুঝতে পারে-এ কথা কখনও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু গরু আর কুকুরগুলো এমন করে কেন? একদিন আচমকা পেয়ে গেলাম তার উত্তর! কীভাবে, সে কথায় পরে আসছি, তার আগে বলে নিই আরেকটা কুসংস্কারের কথা। প্রায়ই শুনি ওমুক গ্রামে কোনো এক পাপী লোকের করব থেকে ধোঁয়া উঠছে। তাই দেখে গাঁয়ের লোকেরা ধরে নেয় তার কঠিন আজাব হচ্ছে। অন্যরা যাতে এমন না করে এজন্য তাদের দেখানো হচ্ছে কঠিন শাস্তি কীভাবে হয়! তখন মৃত ব্যক্তির ছেলে-মেয়েদের বলা হয় দান-খয়রাত করতে। অনেক সময় ভণ্ডরা দুপয়সা হাতিয়ে নেয় তাদের কাছ থেকে।
এসব গল্প কোনোদিনই আমার বিশ্বাস হয়নি। ভাবতাম গালগল্প। কিন্তু বছর তিনেক আগে আমার নানা একটা ঘটনার কথা বললেন। নানা বাড়ির ঠিক পাশের গ্রাম। সেখানে আবার আমার চাচাদের বাড়ি। মানে বাপের চাচাতো ভাইদের বিরাট কলোনি সেই গ্রামে। তো কী ঘটেছিল সেখানে?
সেই কবরস্থানে একটা কবরে প্রথমে নাকি খুব অল্প অল্প ধোঁয়া উঠছিল। দুতিন দিন এভাবেই ধোঁয়ার উদগীরণ ঘটে। সময় যত পেরোয় কুণ্ডলির আকারও তত বড় হয়। তারপর একদিন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। গ্রামের লোকেরা ভয় পায়। ছাদকা তুলে দূর গ্রামের কোনো এক কামেল লোককে নিয়ে মাহফিল করে সেই গাঁয়ের মসজীদে। ধীরে ধীরে কমতে থাকে কবরের আগুন ও ধোঁয়া। একসময় মিলিয়ে যায়। মানুষ ভাবে আজাব বন্ধ হয়েছে।

ব্যাখ্যা-১
বলছিলাম গোরস্থানে কুকুর ও গরুর অস্বাভাবিক আচরণের কথা। একদিন হঠাৎ করেই ব্যাখ্যাটা আমার মাথায় খেলে যায়। গ্রামের গোরস্থানে মানে শিয়ালের আখড়া। মৃত মানুষের মাংস খাবার জন্য সেখানে আস্তানা গড়ে তারা। শোনা যায়, শিয়ালের গর্তের হাজারাটা মুখ। কথাটা পুরোপুরি সত্যি না হলেও অনেকটা সত্যি। শিয়ালের গর্তের অনেকগুলো মুখ থাকে। গোরস্থানে আস্তানা গাড়া শিয়ালের গর্তের অন্তত একটা মুখ থাকে কবরের মাঝখানে। ব্যাটারা দিনের বেলায় ভালো করে শ্বাস প্রশ্বাস নেয়ার জন্য গর্তের মুখের ঠিক কাছে এসে বসে থাকে বা ঘুমায়।
গরু বর্ণান্ধ, কিন্তু ঘ্রাণ শক্তি ভালো। সে যেকোনো জিনিস খাওয়ার আগে শুঁকে দেখে, সেটা তার খাদ্যতালিকার বস্তু কিনা। কারণ যত পরিচিত খাবারই হোক বর্ণান্ধ হওয়ার কারণে গরু তা চিনতে পারে না। প্রখর ঘ্রাণ শক্তির সে তার খাবার চিনতে পারে। গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শিয়ালের গন্ধ পেয়েই গরু এমন উতালা হয়ে ওঠে।
কিন্তু কেন?
একটা ব্যাপার আমি নিশ্চিত হয়েছি-নিজে খেয়াল করে, অন্যকে জিজ্ঞেস করেও- বলদ বা ষাঁড় গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কখনও এমন আচরণ করে না। করে শুধু গাভি। তাও যখন ছোট্ট বাছুর তার সাথে থাকে। যেকোন প্রাণীই তার সদ্য ভূমিষ্ট সন্তান নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকে। প্রসবের পর ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে অতি নীরিহ গাভিও। বাছুরের আশেপাশে কাউকে ভিড়তে দেখলেই শিং উঁচিয়ে তেড়ে যায়। আর শিয়াল তো পোষা প্রাণীদের চিরশত্রু। একলা পেলে একটা বাছুরকে সাবাড় করতে যে তারা একটু দয়ামায়া দেখাবে না- সে কথা প্রকৃতিগতভাবেই গাভিদের শিখে যায়। তাই বাছুরওয়ালা গাভিগুলো গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাবার সময় অমন উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
কিন্তু একটা কবরকে টার্গেট করে কেন?
গোরস্থানে সব কবরে শিয়ালের আস্তানা থাকে না, কিছু কিছু কবরে থাকে, বিশেষ করে নতুন কবরগুলোতে। তো গাভিও সেই কবরেই আক্রমণ শানায়।

এবার আসি কুকুরের কথায়। কুকুর জাতের স্বভাবটাই এমন, স্বজাতিকে এরা সহ্য করতে পারে না। অন্য কুকুর দেখলেই তেড়ে লাগতে যায়।
এখন প্রশ্ন হতে পারে শিয়াল তো তার স্বজাতী নয়?
একেবারে স্বজাতি না হলেও নিকটাত্মীয়। শিয়াল, কুকুর, নেকড়ে, হায়েনা, কোয়েট-এগুলো একটা গোত্র থেকেই এসেছে। কালের বিবর্তনে আলাদা আলাদা জাত হয়ে উঠেছে। অন্য জাতেরা স্বজাত বিরোধী নয়। কুকুরই কেবল স্বজাত বিরোধী। কুকুরের ভেতর এই স্বভাবটা এসেছে বোধহয় মানুষের সাথে বসবাস শুরু করার পর থেকে। তাই কুকুর যেখানেই অপরিচিত স্বজাতিকে দেখে, তেড়ে মারতে যায়, তা সে ভিন পাড়ার অন্য কুকুরই হোক, কিংবা মাঠ বা গোরস্থানের শিয়ালই হোক।

ব্যাখ্যা-২
নানার কাছে কবরের আগুনের গল্পটা শোনার পর মনে হলো, ঘটনাটা সত্যি। তাহলে ব্যাপারখানা কী? একটু ভাবতেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। সাধারণত গাঁয়ের কবরস্থান হয় মাঠে এবং রাস্তার পাশে। নানা যে গোরস্থানের কথা বলেছেন, সেটা আমি ভালোভাবেই চিনি। গোরস্থানে পুরোনো কবরের মাঝখানে গর্ত থাকে। কারণ লাশ মাটি দেয়ার সময় কবরের ভেতর অনেকখানি ফাঁকা জায়গা রাখা হয়। তারপর বাঁশ দিয়ে কবরের উপরে ছাউনির মত দেওয়া হয়। তার ওপরে চাপা দেয়া হয় মাটি। কয়েক মাসের মধ্যে বাঁশ পচে যায়, কিছুদিন পরই ছাউনির সেই পচা বাঁশসহ ওপরের মাটি ধ্বসে কবরের মাঝখানে গর্তের সৃষ্টি করে। অনেক সময় শিয়ালের কারণে গর্তটা আরও বেশি গভীর হয়ে যায়। তারপর সময়ের সাথে গর্তের মাঝখানে গাছপালা, ঘাস জন্মায়। গাছের শুকনো পাতা ঝরে স্তুপ হয়ে যায় কবরের গর্তের ভেতর।
গাঁয়ের চাষীদের কাছে বিড়ি অমৃত সূলভ বস্তু। ভোরে উঠে হয়তো চাট্টে পানি-পান্তা খেয়ে বিড়ি টানতে টানতে মাঠ-পানে যায়। গোরস্থানের কাছে গিয়ে হয়তো তার বিড়ির শেষ হয়ে গেল। বাংলাদেশের শতকরা নব্বুই ভাগ ধূমপায়ী ধূমপানের পর বিড়ি-সিগারেটের পুচ্ছটা না নিভিয়ে যেথানে-সেখানে ছুঁড়ে ফেলতে পছন্দ করেন। আমাদের কৃষক বাবাজিরা তো সে কাজে বড় ওস্তাদ। বিড়ির পুচ্ছটা রাস্তায় কি কবরের মাঝখানে পড়ছে, তা তিনি বলতেই পারবেন না!
যে বিড়িটা কবরের মাঝখানে পড়ল, তাও আবার শুকনো পাতার ভেতর, সাত-সকালে শিশির জমে থাকে পাতার গায়ে। তাই বিড়ির আগুনে পাতা একবারে দপ করে জ্বলে উঠবে না। ধীরে ধীরে ধোঁয়া হতে থাকবে। হয়তো দুদিন লেগে যাবে পুরো আগুন ছড়াতে। রাতে আবার শিশির পড়বে। আগুনের কিছুটা কমবে আবার। তারপর দুপুরের দিকে হয়তো দপ করে জ্বলে উঠবে।
কিন্তু সেই আগুন তো পুরো গোরস্থানেই ছড়িয়ে পড়ার কথা। কেন তা একটা কবরেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
থাকবে। কারণ ওই কবরের গর্ত। যদি হাওয়া না বয় তাহলে গর্তের ভেতর আগুন যে ধরেছে তা গর্তেই সীমাবদ্ধ থাকবে। হাওয়া বইলেও যেহেতু মাটিতে গর্ত, সেখান থেকে আগুনজ্বলা শুকনো পাতা অত সহজে অন্য জায়গায় স্থানান্তর ঘটার সম্ভাবনা কম। হাওয়া জোরে বইলে কিন্তু বিপদ।
সেই আগুন দেখে মানুষ, আর ভয়ের কলকেয় সুখটান দেয়। সংস্কারের ভয়ে কবরের আগুন জ্বললে কেউ তার আশেপাশেই ভিড়তে চায় না। এতে কিন্তু আগুন ছড়িয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে। তাই কবরের আগুন দেখে ভীত না হয়ে সেটা নেভানোর ব্যবস্থা করা উচিত। আর যাদের বিড়ি-সিগারেটের নেশা আছে, তাদের উচিত ওটা শেষ হওয়ার পর নিভিয়ে ফেলা।

কবরে আগুন জ্বলার আরও একটা ব্যাখ্যা আছে। অনেক সময় লঅশ পঁচে কবরের ভেতরে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাস কবরের খোলে জমা হতে হতে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি করে কবরের ভেতর। চাপ যখন খুব বেশি হয়ে যায়, তখন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে গ্যাস। আর মিথেন গ্যাস বাতাসের সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে অক্সিজেনের সাথে দহণ ঘটে। তখন দপ করে জ্বলে ওঠে গ্যাস। সে সময় কেউ এ দৃশ্য দেখলে কী ভাববে বলুন তো?
কুসংস্কার : গোরস্থানে সাবধান! রিভিউ করছেন Unknown তে 11:00 PM রেটিং:

Post Comment

কপিরাইট ২০১৬ © টিপস ওয়ার্ল্ড এর সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ডিজাইন করেছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন

যোগাযোগ

Name

Email *

Message *

Theme images by enot-poloskun. Powered by Blogger.