Top Ad unit 728 × 90

>
[]

মহাবিশ্ব ও বিগ ব্যাং তত্ত্ব

মহাবিশ্ব সংক্রান্ত যে কোন খুললেই আমরা দেখি তা অবধারিতভাবে শুরু হয় বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের গবেষণার মধ্য দিয়ে। একসময় ১৯২৯ সালে বিজ্ঞানী এডউইন হাবল তার বিখ্যাত সেই টেলিস্কোপের সাহায্যে আকাশের গ্যালাক্সিগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন গ্যালাক্সিগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এবং তা দেখেই কিন্তু এক ধরণের ধারনা পাওয়া যায়, দূর অতীতে নিশ্চয় তারা খুব কাছাকাছি ছিল, খুব ঘন সন্নিবদ্ধ অবস্থায় গাঁটবন্দি হয়ে। আর সেই গাঁট-পাকানো অবস্থা থেকেই সবকিছু চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আকস্মিক এক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। এটাই সেই বিখ্যাত ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্ব। এ তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রায় ১৩৭০ কোটি বছর আগে অতি উত্তপ্ত এবং প্রায় অসীম ঘনত্বের এক পুঞ্জিভূত অবস্থা থেকে এক বিশাল বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে উদ্ভব ঘটেছে আমাদের এই সুমহান মহাবিশ্বের।

বর্তমানে আমরা মহাবিশ্বকে যেভাবে দেখি, মহাবিশ্বের ঊষালগ্নে এর প্রকৃতি কিন্তু এরকম ছিল না, এটি ছিল অনেকটাই আলাদা। আজকের দিনে আমরা চারটি মৌলিক বলের কথা শুনতে পাই। সেগুলো হলো – সবল নিউক্লিয় বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল, তাড়িতচৌম্বক বল এবং মাধ্যাকর্ষণ বল। বিজ্ঞানীদের ধারনা এই চারটি বল ‘সুপার ফোর্স’ বা অতিবল হিসেবে একসাথে মিশে ছিল। সে ভাবেই ছিল তারা মহাবিস্ফোরণের ঊষালগ্ন থেকে শুরু করে ১০-৪৩ সেকেন্ড পর্যন্ত। প্রথম এক সেকেন্ডেও মহাবিশ্ব ছিল যেন জ্বলন্ত এক নিউক্লিয় চুল্লি। তাপমাত্রা ছিল একশ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়েও বেশি। সেসময় কোন চেনা জানা কণা ছিল না, চারদিক পূর্ণ ছিল কেবল প্লাজমার ধোঁয়াশায়। এক সেকেন্ড পরে কোয়ার্ক, ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের মত মৌলিক কণিকাগুলি তৈরি হয়। তিন সেকেন্ড পরে প্রোটন আর নিউট্রন মিলে তৈরি হল নিউক্লিয়াস, এর পরে যথাক্রমে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়াম। তবে মহাবিশ্বের উদ্ভবের প্রায় কয়েক লক্ষ বছর পর্যন্ত আমরা যাকে জড়পদার্থ বা ম্যাটার বলি সেরকম কিছুই তৈরি হয় নি। তখন আসলে রঞ্জন রশ্মি, আর বেতার তরঙ্গের মত লম্বা দৈর্ঘ্যের অতি তেজী রশ্মিগুলোই বরং পদার্থের উপর রাজত্ব করছিল। প্রায় চার লক্ষ বছর পরে তাপমাত্রা খানিকটা কমে তিন হাজার ডিগ্রি কেলভিনে নেমে আসার পরই কেবল প্লাজমা থেকে স্থায়ী অণু গঠিত হবার মত পরিবেশ তৈরি হতে পেরেছে। এসময় মহাবিশ্বের কুয়াশার চাদর ধীরে ধীরে সরে গিয়ে ক্রমশ স্বচ্ছ হয়ে আসে, পথ তৈরি হয় ফোটন কণা চলাচলের। আর তার পরই কেবল তেজস্ক্রিয় রশ্মিসমূহের উপর জড়-পদার্থের আধিপত্য শুরু হয়েছে। এর পর আরও প্রায় একশ কোটি বছর লেগেছে গ্যালাক্সি জাতীয় কিছু তৈরি হতে। আর আমাদের যে গ্যালাক্সি, যাকে আমরা আকাশগঙ্গা নামে ডাকি, সেখানে সূর্যের সৃষ্টি হয়েছে আজ থেকে প্রায় পাঁচশত কোটি বছর আগে। আর সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণ্যমান গ্যাসের চাকতি থেকে প্রায় ৪৫০-৪৬০ কোটি বছরের মধ্যে তৈরি হয়েছিল পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো।
বিগ ব্যাং থেকে সবকিছুর শুরু বলে আমরা জানি। কিন্তু মহাবিস্ফোরণের পর মুহূর্তে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম কিংবা লিথিয়ামের মত মৌল তৈরি হলেও কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং লৌহ কিন্তু সে সময় তৈরি হয়নি। এগুলো তৈরি হয়েছে অনেক অনেক পরে কোন না কোন নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ থেকে, যাদের আমরা মহাকাশে সুপারনোভা বলে জানি। বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেছেন, প্রথম নক্ষত্র তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাং ঘটার অন্তত ৭৫ কোটি বছর পরে। আর তারকার বিস্ফোরণ – মানে সুপারনোভার মত ব্যাপার স্যাপার ঘটতে সময় লেগেছিল আরো অনেক।
জর্জ গ্যামো
ছোটবেলায় আমরা গোপাল ভাঁড়ের অনেক গল্প পড়তাম। কিন্তু তখন কি জানতাম, গোপাল ভাঁড়ের চেয়েও রসিক এক বিজ্ঞানী আছেন, তার অবদানের কথা উল্লেখ না করলে বিগ ব্যাং এর ইতিহাসটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। 

তিনি জর্জ গ্যামো। আমরা যে বিগ ব্যাং এর কথা বলি সেই বৈজ্ঞানিক ধারণাটি বিজ্ঞানের জগতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাথমিক কৃতিত্ব অবশ্যই এই কৃতি পদার্থ বিজ্ঞানীর; তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার স্পর্শ কেবল পদার্থবিদ্যা নয়, জ্যোতির্বিজ্ঞান, তেজস্ক্রিয়তা থেকে শুরু করে এমনকি জীববিজ্ঞানেরও নানা শাখায় ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে একক চেষ্টাতেই বলা যায় ‘বিগ-ব্যাং’র ধারণাকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেজন্য অনেকে আজ তাকে অভিহিত করেন ‘বিগ ব্যাং এর পিতা’ হিসেবে।
গ্যামোর আদি নিবাস ছিল রাশিয়ায়। আমরা যে ফ্রিডম্যানের কথা জানি, যিনি এক সময় আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের গাণিতিক সমাধান হাজির করেছিলেন মহাবিশ্বের প্রসারণ তুলে ধরতে, সেই আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান ছিলেন এক সময় গ্যামোর শিক্ষক, পড়াতেন পেট্রোগ্রাডে ১৯২৩ -২৪ সালের দিকে। বোঝাই যায় গুরু মারা বিদ্যা ভালই রপ্ত করেছিলেন গ্যামো।
গ্যামো নিজে থেকে ‘বিগ ব্যাং’ শব্দটি চয়ন করেন নি। গ্যামোর ধারণাকে খণ্ডন করতে গিয়ে আর এক প্রখ্যাত তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রেডারিক হয়েল সর্ব প্রথম এই বিগ-ব্যাং শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। হয়েল ছিলেন বিগ-ব্যাং তত্ত্বের বিপরীতে স্থিতিশীল অবস্থা নামে মহাবিশ্বের অন্য একটি জনপ্রিয় মডেলের প্রবক্তা। হয়েলের তত্ত্বের সাথে প্রথম দিকে যুক্ত ছিলেন কেম্ব্রিজ কলেজের হারমান বন্দি, থমাস গোল্ড আর পরবর্তীকালে একজন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তাঁর নাম জয়ন্ত নারলিকর। ১৯৪০ সালে একটি রেডিও প্রোগ্রামে হয়েল গ্যামো আর তাঁর অনুসারীদের ধারণাকে খণ্ডন করতে গিয়ে বেশ বাঁকা সুরেই অধ্যাপক হয়েল বলেছিলেন,
‘হাঃ সেই উত্তপ্ত বিগ ব্যাং’ – এই বিস্ফোরণের ধারণা যদি সঠিকই হবে, তবে তো এর ছাই-ভস্ম এখনও কিছুটা থেকে যাওয়ার কথা। আমাকে ‘বিগ ব্যাং’ এর সেই ফসিল এনে দেখাও, তার পর অন্য কথা।’
এর পর থেকেই বিগ-ব্যাং শব্দটি ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের জগতে স্থায়ী আসন করে নেয়। সে যাই হোক, আলফারের পিএচডি’র শেষ পর্যায়ে আলফার ও গ্যামো যুক্তভাবে ‘Physical Review’ জার্নালের জন্য ‘Origin of the Chemical Elements’ শিরোনামে একটি গবেষণা নিবন্ধ লিখতে শুরু করলেন। আর এখানেই রসিকরাজ গ্যামো বিজ্ঞান জগতের সবচাইতে বড় রসিকতাটি করে বসলেন। জার্নালে ছাপানোর আগে তিনি তাঁর বন্ধু আর এক স্বনামখ্যাত পদার্থবিদ হ্যানস বিথের নাম তাঁকে না জানিয়েই প্রবন্ধটির লেখক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। পরে কারণ হিসেবে বলেছিলেন, “‘আলফার’ আর ’গ্যামো’- এই দুই গ্রীক ধরণের নামের মাঝে ‘বিটা’ জাতীয় কিছু থাকবে না, এ হয় নাকি? তাই বিথেকে দলে নেওয়া!” সত্য সত্যই ১৯৪৮ সালের ১লা এপ্রিলে এই তিন বিজ্ঞানীর নামে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল, আর গ্যামোর রসিকতাকে সত্যি প্রমাণিত করে পেপারটি এখন ‘আলফা-বিটা-গামা পেপার’ নামেই বৈজ্ঞানিক মহলে সুপ্রতিষ্ঠিত।
কিন্তু সেই প্রবন্ধটিতে কি বলেছিলেন গ্যামো?
তিনি ধারণা করেছিলেন যে, একটি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে যদি মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে সেই ভয়ঙ্কর বিকিরণের কিছুটা স্বাক্ষর, মানে বিকিরণ-রেশের কিছুটা এখনও বজায় থাকার কথা। গ্যামো হিসেব কষে দেখালেন যে, সৃষ্টির আদিতে যে তেজময় বিকিরণের উদ্ভব হয়েছিল, মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে তার বর্ণালী তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পেতে সেটা এখন পরম শূন্য তাপমাত্রার উপরে ৫ ডিগ্রি কেলভিনের মত হওয়া উচিত। এই তেজময় বিকিরণের অবশেষকেই বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিকিরণ’ বা ‘cosmic back ground radiation’। মহাশূন্যে এই বিকিরণের প্রকৃতি হবে মাইক্রোওয়েভ বা ক্ষুদ্র তরঙ্গ। সহজ কথায় বিষয়টি বুঝবার চেষ্টা করা যাক। সৃষ্টির আদিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছিল যেন একটি উত্তপ্ত মাইক্রোওয়েভ চুল্লি যা এখন ঠাণ্ডা হয়ে ৫ ডিগ্রি কেলভিনে এসে পৌঁছেছে। এই ব্যাপারটিই ধরা পড়ল ১৯৬৪ সালে আর্নো পেনজিয়াস আর রবার্ট উইলসনের পরীক্ষায়, গ্যামোর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবার ১৬ বছর পর। গ্যামোর সেই গবেষণাপত্রটির কথা ততোদিনে ভুলেই গিয়েছিল সবাই। কিন্তু সেখানে যাবার আগে আমাদের আরেকজন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীর কথা জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
জর্জ লেমিত্রি এবং তাঁর ‘আদিমতম কণা’
বিগ ব্যাং-এর কথা বললে এর পেছনে আরেকজন ব্যক্তির অবদানের কথা উল্লেখ না করলে তাঁর প্রতি নিতান্তই অবিচার করা হবে। তিনি হলেন জর্জ হেনরি লেমিত্রি (Georges Lemaître), বিগ ব্যাং তত্ত্বের আর একজন প্রবক্তা- যিনি ছিলেন একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী এবং সেই সাথে ধর্মযাজক। নাস্তিক গ্যামোর মত ধর্মযাজক লেমিত্রিও কিন্তু বিগ ব্যাং-এর পিতা খেতাব পাবার যোগ্য দাবীদার,এবং অনেকে সেটা তাকে ডাকেনও।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা থেকে প্রাপ্ত ক্ষেত্র সমীকরণের একটা সমাধান হাজির করেছিলেন লেমিত্রি, বিজ্ঞানী ফ্রিডম্যানের মতোই। গ্যামোর মতো তিনিও ছিলেন মহাজাগতিক কালপঞ্জির এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি তার শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন প্রকৌশলী (পুরকৌশলী) হিসেবে, বেলজিয়ামের ক্যাথলিক লুভেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় জার্মান সৈন্যরা বেলজিয়াম আক্রমণ করলে তার পড়াশোনায় সাময়িক ছেদ পড়ে। তিনি ‘আর্টিলারি অফিসার’ হিসেবে বেলজীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন আর সেখানে কাজ করেন চার বছরের জন্য। বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি সিভিল ইঞ্জিয়ারিং-এ আর না ফিরে গিয়ে পদার্থবিদ্যা এবং গণিত নিয়ে উৎসাহী হয়ে পড়েন তিনি। ১৯২০ সালে অর্জন করেন পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি। পাশাপাশি ধর্মযাজকের পেশায়ও উৎসাহী হয়ে পড়েন তিনি। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সত্যে পৌঁছনোর দুইটি পথ। আমি দুটোই অনুসরণ করতে মনস্থ হলাম’।
পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি সে সময়কার বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের সাহচর্য লাভ করেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এডিংটন তার গাণিতিক দক্ষতা এবং পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞানে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এডিংটন তার সম্বন্ধে বলেছিলেন,
‘তুখোড় এক ছাত্র – করিৎকর্মা, স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন এবং গনিতে দক্ষ’।
লেমেত্রি এক সময় কেম্ব্রিজের পাঠ চুকিয়ে চলে গেলেন আমেরিকায়। এমআইটিতে করলেন পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় বারের মতো পিএচডি।
১৯২৫ সালে তিনি বেলজিয়ামে ফিরে গিয়ে তার পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে যোগ দিলেন। সেখানেই তিনি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণের উপর ভিত্তি করে নিজের মহাজাগতিক মডেল তৈরি করে ফেললেন। তার সমাধান ছিল অনেকটা পূর্বসূরি ফ্রিডম্যানের মতোই। এ সমাধানে মহাজাগতিক ধ্রুবক গোনায় ধরার দরকার পড়েনি তার। তার সমাধান থেকে বেরিয়ে আসলো মহাবিশ্ব ক্রমশঃ প্রসারিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সময়ের ঘড়িকে পেছনের দিকে চালিয়ে তিনি একদম শুরুর মানে ব্রাহ্ম-মুহূর্তের একটা ছবিও আঁকলেন তার গণিত আর বিজ্ঞানের কল্পনায়, কাব্যিক ভাবে সে সময়টাকে অভিহিত করলেন ‘A Day without yesterday’ হিসেবে। তিনি এই মহাবিশ্বের সমস্ত গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকাকে চেপে ঠেসে ঘন সন্নিবদ্ধ এক ছোট্ট মহাবিশ্বে পরিণত করলেন, আর তার নাম দিলেন ‘প্রাইমিভাল এটম’ বা আদিম কণা নামে। লেমেত্রির কাছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারটা ছিল সেই আদিম কণা নামের শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় কণাটির অবক্ষয়, যা থেকেই তৈরি তৈরি হয়েছে এই বিশ্বজগত।
লেমেত্রি তার আদিম কণা তত্ত্ব আর মহাবিশ্বের প্রসারণের ব্যাপারে মহা উৎসাহী হয়ে উঠলেলেও তার উৎসাহের বেলুন কিন্তু রাতারাতি চুপসে গেল। আর চুপসে দিয়েছিলেন আইনস্টাইন স্বয়ং। আইনস্টাইনের মাথায় তখন ‘স্থিতিশীল মহাবিশ্বের’ ভুত। তার নিজের সমীকরণেই মহাবিশ্বের প্রসারণের ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকলেও মহাজাগতিক ধ্রুবক ঢুকিয়ে সেটাকে স্থিতিশীল রূপ দিয়ে রেখেছেন তিনি। ফ্রিডম্যান কিংবা লেমেত্রি, যারাই মহাজাগতিক ধ্রুবকের বাইরে গিয়ে সমাধান হাজির করছেন, তাদেরকে কান মলে দিয়ে বাতিল করে দিচ্ছেন। তাই ১৯২৭ সালে ব্রাসেলসের একটা সেমিনারে লেমিত্রি যখন তার মহাজাগতিক মডেল আইনস্টাইনের সামনে তুলে ধরলেন, আইনস্টাইন বিনা বাক্য ব্যয়ে বাতিল করে দিলেন এই বলে –
‘তোমার ক্যালকুলেশন ঠিকি আছে, কিন্তু তোমার ফিজিক্সটা তো বাপু জঘন্য’।

কিন্তু আইনস্টাইনের ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। ১৯২৯ সালে হাবল যখন মাউন্ট উইলসন মানমন্দির থেকে সে সময়কার ১০০ ইঞ্চি ব্যাসের সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপের (হুকার প্রতিফলক) সাহায্যে প্রমাণ হাজির করলেন যে মহাবিশ্ব আসলে প্রসারিত হচ্ছে, তখন কিন্তু আইনস্টাইনই ভুল প্রমাণিত হলেন, আর লেমেত্রি হলেন সঠিক।
লেমেত্রি নিঃসন্দেহে খুশি হয়েছিলেন। নিজের তত্ত্বের স্বপক্ষে প্রমাণ পেলে কার না খুশি লাগে। কিন্তু লেমেত্রি যত না খুশি হলেন, ধর্মের চিরন্তন ধ্বজাধারীরা মনে হয় খুশি হলেন তার চেয়েও ঢের বেশি। তারা বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ের সাথে এর মিল খুঁজতে শুরু করলেন, আর ‘বিগ ব্যাং’ কিংবা আদি কণাকে হাজির করলেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে। যেমন ১৯৫১ সালে পোপ বলেছিলেন –
‘আজকে বিজ্ঞান শতাব্দী পাড়ি দিয়ে একটি জায়গায় পৌঁছেছে যখন সেই আদিম ফিয়াট লাক্স (লেট দেয়ার বি লাইট)কে অবলোকন করার মত পরিস্থিতি এসেছে – যে আদিম অবস্থা থেকে আলো এবং শক্তির বিকিরণ ঘটেছে, আর উৎক্ষিপ্ত কণাগুলো দ্বিখণ্ডিত আর চূর্ণ হয়ে লক্ষ কোটি ছায়াপথে পরিণত হয়েছে। কাজেই সুদৃঢ় বৈজ্ঞানিক কাঠামো থেকে পাওয়া ফলাফলের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত যে, এই মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল সৃষ্টিকর্তার হাতে। যদি সৃষ্টির শুরু থাকে, তবে অবশ্যই এই সৃষ্টির একজন স্রষ্টাও রয়েছে, আর সেই স্রষ্টাই হলেন ঈশ্বর’।
লেমেত্রি যেহেতু ধর্মযাজক ছিলেন, ছিলেন খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী একজন বিজ্ঞানী, সেহেতু কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে পোপের এই উক্তিতে লেমেত্রি যার পর নাই খুশি হয়ে বগল বাজাবেন। তা হয়নি। লেমেত্রি ধার্মিক হলেও তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনিষ্ঠ এক মানুষ। আদিম কণার ধারনা যেটাকে আধুনিক বিগ ব্যাং এর সার্থক প্রতিভাস বলে মনে করা হয়, সেটা তিনি পেয়েছিলেন নিগূঢ় গণিত আর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োগে, কোন ধর্মীয় ঐশী মন্ত্রে নয়। তিনি সেটা সোজাসুজি বলতেনও –
‘কোন ধর্মীয় চেতনা আমাকে মহাজাগতিক মডেল নির্মাণে কখনোই অনুপ্রাণিত করেনি’।
তিনি কূপমণ্ডূক ধর্মবাদীদের মত বাইবেলের আয়াতে বিজ্ঞান খোঁজা কিংবা বিজ্ঞান আর ধর্মের গোঁজামিল দেয়াকে সবসময়ই অপছন্দ করতেন। তাই পোপ যখন বাইবেলকে ঐশী-গ্রন্থ বানাতে বিগব্যাংকে সাক্ষীগোপাল হিসেবে হাজির করলেন, তখন তিনি এর জবাবে বললেন,
‘আমি যতদূর দেখছি, এই তত্ত্ব অধিপদার্থবিদ্যা আর ধর্মের চৌহদ্দির বাইরের জিনিস’।
শুধু তাই নয় পোপ যেন ভবিষ্যতে এ ধরণের ছেলেমানুষি আর না করেন, সেজন্য তিনি ভ্যাটিকান মানমন্দিরের পরিচালক ড্যানিয়েল ও’কনেলের সাথে দেখা করলেন। ভবিষ্যতে পোপ যেন মহাজাগতিক ব্যাপারে তার লম্বা নাকটা আর না গলান – ব্যাপারটা দেখতে পরিচালক মশাইকে অনুরোধ করে আসেন লেমিত্রি। পরবর্তী ইতিহাস থেকে দেখা যায়, পোপ কিন্তু লেমেত্রির অনুরোধ ঠিকই রেখেছিলেন। বিগ ব্যাং এর ব্যাপারে তিনি আর কখনোই কোন অভিমত দেননি।
বিগ ব্যাং এর প্রমাণ 
গ্যামো আর আলফার বুঝেছিলেন, মহাবিস্ফোরণের পর থেকে শুরু করে তিন লক্ষ আশি হাজার বছর পর্যন্ত মহাবিশ্ব অস্বচ্ছ গোলকের মত ছিল অনেকটা। প্লাজমা অবস্থায় অণুরা জোড় বাধতে পারেনি। প্রায় চার লক্ষ বছর পরে তাপমাত্রা খানিকটা কমে তিন হাজার ডিগ্রি কেলভিনে নেমে আসল। ঐ সময়টার পরই কেবল স্থায়ী অণু গঠিত হবার মত পরিবেশ তৈরি হতে পেরেছে। এই সময়টাকে বলে রিকম্বিনেশন বা পুনর্মিলনের যুগ। এ সময়ই মহাবিশ্ব ক্রমশঃ স্বচ্ছ হয়ে আসে। আর আলোক কণা প্লাজমার খাঁচায় আটকে না থেকে পাড়ি দিতে শুরু করে অন্তবিহীন পথ। গ্যামো, আলফার আর আলফারের আরেক সঙ্গী হারমান তাদের গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, বিগ ব্যাং যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সেই আলোর অপভ্রংশ আমাদের এখন খুঁজে পাবার কথা। সেটাই হবে বিগ ব্যাং এর ফসিল, যেটার জন্য হয়েল আর গোল্ডেরা উৎসুক ছিলেন, আর ওটার অনুপস্থিতির সুযোগে মহাবিস্ফোরণের সমর্থকদের দেদারসে ব্যাঙ্গ করেছেন। গ্যামোরা জানতেন, বিগ ব্যাং এর পর থেকে মহাবিশ্ব হাজার গুণ প্রসারিত হয়েছে। তাই যে আলোক তরঙ্গ দেখবার প্রয়াস নেয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটা আজকের দিনে হবে মোটামুটি ১ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের কাছাকাছি কোন তরঙ্গ। অর্থাৎ, তড়িচ্চুম্বকীয় পরিসীমায় যাকে সনাক্ত করা যাবে বেতার তরঙ্গ হিসেবে। আর এই বিকিরণের তাপমাত্রা হবে পাঁচ ডিগ্রি কেলভিনের মত। আসলে গ্যামোর সময়ে মহাবিশ্বের প্রান্তিক বিষয় নিয়ে গবেষণাগুলোকে পদার্থবিজ্ঞানের মূল ধারা হিসেবে না দেখে দেখা হত পাগলাটে বিজ্ঞানীদের কল্পনাবিলাস হিসেবে। আরেকটা মূল কারণ অনেকে মনে করেন জর্জ গ্যামোর স্বভাবসিদ্ধ ভাঁড়ামি আর রঙ্গপ্রিয়তা। আলফা-বিটা-গামা নামের পেপার বানানোর জন্য বিথের নাম তাকে না জানিয়েই লেখক তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন গ্যামো, আমরা সেটা আগেই জেনেছি। এ ধরণের অনেক কিছুই গ্যামো করতেন, যার কারণে গ্যামোকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন না তার সহকর্মীরা কিংবা অন্যান্য রাশভারী গবেষকেরা। গ্যামো একবার গণনা করে দেখালেন ঈশ্বর মশাই নাকি পৃথিবী থেকে ৯.৫ আলোকবর্ষ দূরে থাকেন। গণনার হিসেবটা এসেছিল ১৯০৪ সালে জাপান-রাশিয়া যুদ্ধের সময়, রাশিয়ার কিছু চার্চ নাকি যুদ্ধের ভয়াবহতা কমানোর জন্য বিশেষ গণপ্রার্থনার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সে প্রার্থনায় তাৎক্ষণিক কোন ফল না হলেও বেশ ক’বছর পর – ১৯২৩ সালের দিকে ক্যান্টো ভূমিকম্পে জাপানের বিরাট ক্ষয় ক্ষতি হয়েছিল। এ থেকে গ্যামো সিদ্ধান্তে আসেন, ঈশ্বরের অভিশাপ আলোর বেগে এসে পৌঁছাতে যে সময় লেগেছে তাতে করে পাওয়া যায় ঈশ্বর থাকেন পৃথিবী থেকে ৯.৫ আলোকবর্ষ দূরে! তিনি একটা সময় বিজ্ঞানী হয়েলকে নিয়ে বাইবেলের জেনেসিসের আদলে নিজস্ব এক নতুন জেনেসিসও লিখেছিলেন। এর পাশাপাশি ছিল তার শিশু কিশোরদের জন্য লেখা মজাদার ‘মিস্টার টম্পকিন্স’ সিরিজ। বিজ্ঞানের ফ্যান্টাসি মিশিয়ে নানা ধরণের গালগপ্প বানাতেন গ্যামো। এমনি একটা বইয়ে তিনি এমন একটা রাজ্যের কল্পনা করলেন যেখানে আলোর গতি প্রতি ঘণ্টায় মাত্র কয়েক কিলোমিটার। ফলে সেই রাজ্যের সাইকেল আরোহীরা সাইকেল চালাতে চালাতেই সময়ের শ্লথতা কিংবা দৈর্ঘ্যের সংকোচনের মত আপেক্ষিকতার প্রভাবগুলো চোখের সামনে দেখতে আর অনুভব করতে পারেন। বিজ্ঞানের গল্পপ্রিয় শিশু কিশোর আর কল্পনাবিলাসী পাঠকেরা এগুলোতে নির্মল আনন্দ পেলেও গ্যামোর প্রতিপক্ষদের কাছে এগুলো ছিল স্রেফ ছেলেমানুষি, আর তুচ্ছ। তার ছাত্র আলফারের সমস্যা হয়েছিল আরো বেশি। গ্যামোর তদারকিতে পিএইচডি করায় অনেকেই আড়ালে আবডালে বলতেন, ‘জোকারের আণ্ডারে’ পিএইচডি করছেন আলফার। যদিও মহাজাগতিক বিকিরণের মূল গণনাগুলো করেছিলেন আলফারই। ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলো বিগ ব্যাং নিয়ে গ্যামোর গবেষণা, এক সময় পড়ল বিস্মৃতির ধুলোর পুরু স্তর। ‘আউট অব সাইট, আউট অব মাইণ্ড’ বলে কথা।
এর পরের দশ বছর এভাবেই চলেছিল। এর মধ্যে ১৯৬০ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ রবার্ট ডিকি এবং জিম পিবলস স্বাধীনভাবে গবেষণা করে সিদ্ধান্তে আসেন যে বিগ ব্যাং এর প্রমাণ যদি কিছু থেকে থাকে তা থাকবে সেই মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের মধ্যেই। তারাও গ্যামোর কাছকাছিই ফলাফল পেয়েছিলেন। তাদের হিসেব ছিল, বিকিরণের তাপমাত্রা হবে ১০ ডিগ্রী কেলভিন বা তার নীচে, আর বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কয়েক সেন্টিমিটার। তারা গ্যামো আর তার দলের মতোই একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করার চিন্তা করছিলেন এ নিয়ে। কিন্তু গবেষকদের গবেষণাপত্রে যাই থাকুক না কেন, বাস্তবে এর খোঁজ তখনো পাওয়া যায়নি। ১৯৬৫ সালের দিকে আমেরিকার নিউ জার্সির বিখ্যাত বেল ল্যাবে আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন বেতার যোগাযোগের মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ নিয়ে কাজ করছিলেন। এমন নয় যে কোন তরঙ্গ ফরঙ্গ খোঁজার মত কোন কিছু তাদের মাথায় ছিল। তাদের লক্ষ্য আসলে ছিল উপগ্রহ যোগাযোগব্যবস্থায় সমস্যা করা। বেল ল্যাবের অনতিদূরে ক্রেফর্ড হিল বলে একটা জায়গায় ৬ মিটার লম্বা একটা ‘হর্ন এন্টেনা’ পড়ে ছিল। এই একসময় বেল ল্যাবের ‘ইকো প্রজেক্ট’ বলে একটা প্রকল্পে এটা ব্যবহার করার কথা ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য নানা কারণে সেই প্রকল্প থেকে যন্ত্রটাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তারপর থেকে ওটা ওভাবেই পড়ে ছিল। পরিত্যক্ত এই এন্টেনাকে রেডিও টেলিস্কোপের মতো কোন কিছুতে স্থানান্তরিত করা যায় কিনা, এ নিয়ে কাজ করতেই মূলতঃ উদ্যোগী হন পেনজিয়াস আর উইলসন। তারা বেল ল্যাব থেকে অনুমতি নিয়ে আসলেন যাতে এই এন্টেনা ব্যবহার করে তারা অন্তত কিছুদিন আকাশের দিকে তাক করে বেতার তরঙ্গ অনুসন্ধান করতে পারেন।
কিন্তু অনুসন্ধান করতে চাইলে কি হবে, আকাশের যেদিকেই এন্টেনা তাক করেন না কেন, তারা দেখেন এক অপ্রীতিকর আওয়াজ বা নয়েজ এসে সব ভজকট লাগিয়ে দিচ্ছে। এই নয়েজের মাত্রা এমনিতে খুবই কম, কিন্তু এই নয়েজ থেকে কোনভাবেই মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না যে! এমন নয় যে এই আওয়াজ তাদের কাজে খুব বেশি সমস্যা করছিল। সাধারণত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এ ধরণের নয়েজকে সিস্টেমের ভ্রান্তি ধরে নিয়ে মূল কাজে এগিয়ে যান, কিন্তু পেনজিয়াস আর উইলসন নাছোড়বান্দা হয়ে পড়েই রইলেন – তারা এই আওয়াজের উৎস খুঁজে বের করবেন বলে।
এ ধরণের ক্ষেত্রে নয়েজের উৎস এবং প্রকৃতি হয়ে থাকে দুই ধরণের। এই নয়েজ আসতে পারে কোন বহির্জাগতিক উৎস থেকে, কিংবা হতে পারে কোন যন্ত্রের নিজস্ব ত্রুটির কারণে। প্রথমে বহির্জাগতিক কোন উৎস ঝামেলা পাকাচ্ছে কিনা সেটা সন্ধান করলেন এই দুই বিজ্ঞানী। হর্ন এন্টেনার কাছাকাছি অবস্থিত কোন বৃহৎ তড়িৎ-আবিষ্ট ল্যান্ডমার্ক কিংবা কোন বৈদ্যুতিক যন্ত্রের কারণে এই বৈদ্যুতিক সঙ্কেত তাদের এই হর্ন এন্টেনায় ধরা পড়ছে কিনা তার খোঁজ করলেন। ফলাফল সেই শূন্য। এমনকি একসময় আকাশ পর্যবেক্ষণ বাদ দিয়ে নিউইয়র্কের দিকেও তাদের টেলিস্কোপ তাক করলেন। সঙ্কেতের কোন তারতম্য হল না। যেদিকেই যন্ত্র তাক করেন সেদিকেই তারা শুনতে পান সেই একই মৃদু ‘হিস্‌ হিস্‌’ শব্দ।
ঝামেলাটা যন্ত্রের নিজস্ব ত্রুটির কারণে হচ্ছে কিনা সেটাও অনুসন্ধান করলেন তারা। তারা যন্ত্রের এমপ্লিফায়ার, স্পিকারগুলো খুঁটিয়ে দেখলেন, আর সবচেয়ে বেশি দেখলেন বৈদ্যুতিক বর্তনী এবং বর্তনীর সংযোগস্থানগুলো। কোন শিথিল বা নড়বড়ে বৈদ্যুতিক সংযোগ সমস্যা সৃষ্টি করছে নাকি, সেটাও আগাপাশতলা পরীক্ষা করলেন বহুবার। এমনকি যে সংযোগগুলো প্রথম দৃষ্টিতে ভালই মনে হচ্ছিল, সেগুলোকেও তারা অ্যালুমিনিয়ামের টেপ দিয়ে মুড়লেন পুনর্বার। কিন্তু কোন কিছু করেই এই ‘গায়েবী আওয়াজ’ সরানো যাচ্ছিল না। এমন সময় তাদের নজরে পড়ল তাদের সাধের এন্টেনায় কোত্থেকে একজোড়া কবুতর এসে বাসা বেঁধেছে। কে জানে অনেকদিন ধরেই হয়তো তারা সেখানে ঘাপটি মেরে ছিল। পেনজিয়াস আর উইলসন ভাবলেন, যাক এইবার হতচ্ছাড়া সংকেতের উৎস খুঁজে পাওয়া গেছে। ২০ ফুট এন্টেনা বেয়ে উপরে উঠে গিয়ে কবুতরের বর্জ্য পরিষ্কার করলেন, কারণ তারা ভেবেছিলেন এন্টেনায় জমা হওয়া এই ‘White dielectric material’ গুলোই যত নষ্টের গোঁড়া। কিন্তু সেগুলো সাফসুতরো করেও লাভ হল না, এমনকি দুই দফা কবুতর তাড়িয়েও না।
প্রায় হাল ছেড়ে দেয়া অবস্থা যখন, তখনই পেনজিয়াস এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্নার্ড ব্রুকের কাছ থেকে একটা টেলিফোন কল পান। ব্রুক তাকে বলেন যে তিনি প্রিন্সটনের দুই গবেষক – ডিকি আর পিবলসের একটা গবেষণাপত্রের ড্রাফট কপি পেয়েছেন, যেখানে তারা বিগ ব্যাং এর মডেলের ক্ষেত্রে বিস্ফোরণ পরবর্তী অণুতরঙ্গ দৈর্ঘ্যের একটা মাপজোক করেছেন। ব্রুকের কেন যেন মনে হচ্ছে ডিকি-পিবলসের গবেষণার সাথে পেনজিয়াস -উইলসনের এন্টেনায় ধরা পড়া আওয়াজের কোথাও একটা সম্পর্ক আছে। ব্রুক বললেন,
‘ইউ শুড প্রোবাবলি কল ডিকি অ্যাট প্রিন্সটন’
এর পরদিনই প্রিন্সটনে ফোন করলেন পেনজিয়াস, আর ফোন ধরলেন ডিকি। ডিকির সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই প্রথম বারের মত পেনজিয়াস বুঝতে পারলেন কী গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে ফেলেছেন তারা নিজেদের অজান্তেই। এন্টেনায় ধরা আওয়াজের সাথে নিউইয়র্কের দিকে এন্টেনা তাক করা, বর্তনীর শিথিল সংযোগ কিংবা কবুতরের বিষ্ঠা – কোন কিছুরই কোন সম্পর্ক নেই। তারা আসলে খুঁজে পেয়েছেন মহাবিস্ফোরণের প্রাচীনতম ফসিল। মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন যাকে বলে। পশ্চাৎপট বিকিরণের তীব্রতা মেপে ডিকি-পিবলসদের গণনার কাছাকাছি ফলাফল পেয়েছেন তারা। পরম শূন্যের উপর ৩ ডিগ্রি। আর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পাচ্ছেন দুই মিলিমিটারের সামান্য কম। পেনজিয়াসের এই সব কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন ডিকি। ফোন রেখে তার ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘বয়েস, উই হ্যাভ বিন স্কুপড’

এর পরদিনই ডিকি তার সাথে আরো দু’জন পদার্থবিদকে নিয়ে প্রিন্সটন থেকে ৩০ মাইল গাড়ি চালিয়ে নিউজার্সির হোলম্যান টাউনশিপে পৌঁছালেন। সেখানেই বেল ল্যাবের রিসার্চ সেন্টার। সেখানে পেনজিয়াস আর উইলসনের পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফলগুলো হাতে কলমে দেখে নিশ্চিত হলেন, হ্যাঁ যে সিগনাল তারা অ্যান্টেনায় পাচ্ছেন, সেটা মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণই বটে। তখনই দুই দল মিলে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করতে মনস্থ করলেন অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নালে। তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পর পেনজিয়াস আর উইলসনের এই আবিষ্কারটিকে বিজ্ঞানের জগতে অন্যতম সেরা আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃত হয় প্রায় সর্বত্রই। নাসার নভোচারী রবার্ট জ্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘পেনজিয়াস আর উইলসন আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিগত পাঁচশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা আবিষ্কারটি করছেন’। হার্ভার্ডের পদার্থবিদ এডওয়ার্ড পার্সেল ছিলেন আরো এককাঠি বাড়া। তিনি বলেছিলেন, ‘যে কোন কারো দেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এটি’।
এই মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বা সিএমবি আবিষ্কারের জন্য পেনজিয়াস ও উইলসন নোবেল পুরস্কার পান ১৯৭৮ সালে- গ্যামোর মৃত্যুর দশ বছর পরে। লেমিত্রিও মারা গিয়েছেন ততদিনে। মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার প্রদানের কোন রীতি নেই, থাকলে গ্যামোকে চোখ বন্ধ করে বোধ হয় তখন নির্বাচিত করা হত, যিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় বিগ-ব্যাং’র ধারণাকে বিজ্ঞানের জগতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বোধ হয় কিছু বৈজ্ঞানিক অবদান সব সময় থেকে যাবে যা নোবেল প্রাইজের চেয়েও বেশি দামী আর গুরুত্বপূর্ণ।
বিগ ব্যাং এর ফসিল 
পেনজিয়াস আর উইলসন মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের হদিস দিলেও সেটা খুব নিখুঁত ছিল না। কারণ বিজ্ঞানীরা জানতেন, মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ বড় স্কেলে সুষম মনে হলেও ছোট স্কেলে কিছুটা হলেও ‘ফ্লাকচুয়েশন’ বা অস্থিতি বজায় থাকতে হবে। এই অস্থিতিটুকুই কাজ করবে ভবিষ্যৎ-গ্যালাক্সি তৈরির বীজ হিসেবে।
কিন্তু এই অস্থিতি ধরে ফেলা কোন সহজ ব্যাপার নয়। অনেক সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির দরকার। সত্তুরের দশকে যে সমস্ত যন্ত্রপাতি ছিল তা দিয়ে একশ ভাগের এক ভাগ মাত্রায় ফ্লাকচুয়েশন পরিমাপ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এতে কোন অস্থিতি ধরা পড়েনি। আবহমণ্ডলের মধ্যকার রশ্মিগুলো ঝামেলা করছে ভেবে বেলুন ফেলুন উপরে পাঠিয়ে নানা পরীক্ষা করা হল, তাতেও কোন ভাল ফলাফল এলো না। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বহু খরচাপাতি করে নাসা একটা কৃত্রিম উপগ্রহ বানিয়েছিল কোবে নামে ১৯৮৯ সালে। এই মহাজাগতিক বিকিরণ কব্জা করার লক্ষ্যেই বানানো হয়েছিল সেটা। সেই কোবে আদিম সদ্যজাত মহাবিশ্বের এক দুর্লভ ছবি আমাদের কাছে এনে দিল – যার মধ্যে পাওয়া গেল অস্থিতির সুস্পষ্ট চিহ্ন। ব্যাপারটা চিন্তা করা যাক। আমাদের আজকের এই মহাবিশ্বের বয়স ১৪ শ কোটি বছরের বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আর এই কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা সিএমবির যে ছবিটা আমরা দেখি সেটা মহাবিশ্ব জন্মানোর মাত্র চার লক্ষ বছরের।
১৯৯২ সালে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সেমিনারে য খন এই ফলাফল প্রকাশ করা হল, আর সে সভায় উপস্থিত ১৫০০ জন বিজ্ঞানীর সবাই যখন হতবাক হয়ে দেখলেন কোবের মাইক্রো তরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের উপাত্ত ২ দশমিক ৭৩ ডিগ্রি কেলভিনের কৃষ্ণকায়া বিকিরণের তত্ত্বীয় রেখার সাথে প্রায় পুরোপুরি মিলে গেল, তখন মুহুর্মুহু করতালিতে ফেটে পড়ল পুরো সভাঘর।
প্রিন্সটনের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী অস্ট্রিকার টিউমেন্ট করলেন,
‘যখন পাথরের খাঁজে ফসিল পাওয়া যায় তখন আমাদের চোখে প্রজাতির উদ্ভবের ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। কোবে আমাদের জন্য মহাবিশ্বের ফসিল নিয়ে এসেছে’।
কথাটা মিথ্যে নয়। এই সিএমবি সদ্যজাত মহাবিশ্বের ফসিলই তো। কিন্তু তারপরেও একটা ব্যাপার হল, কোবের পাঠানো ছবি খানিকটা হলেও ঝাপসা ছিল। আর কোবের সংবেদনশীলতা ছিল কেবল ৭ ডিগ্রি কোনের চেয়ে বড় ফ্লাকচুয়েশনগুলো কব্জা করার মতো পর্যায়ের। কিন্তু এর চেয়েও সূক্ষ্ম ফ্লাকচুয়েশন ধরার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০০৩ সালে ডব্লিউ-ম্যাপ উপগ্রহের পাঠানো উপাত্তের জন্য।
পেনজিয়াস –উইলসন, কোবে এবং ডব্লিউ ম্যাপ থেকে পাওয়া মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ
কোবে এবং ডব্লিউ ম্যাপের পাঠানো মহাজাগতিক বিকিরণের ফসিলই বিগ ব্যাং বনাম স্থিতি তত্ত্বের দ্বন্দ্বের যবনিকা ফেলে দেয়। মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে তত্ত্বের দ্বন্দ্বে বিগ ব্যাং বেরিয়ে আসে একমাত্র ‘সুপার পাওয়ার’ হিসেবে।
‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের গৌরবময় সাফল্য বিজ্ঞানীদের একেবারে সম্মোহিত করে রেখেছিলো বেশ অনেক দিন। সবকিছুই সেই উত্তপ্ত মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে একসাথে সৃষ্টি হয়েছে, আর তার আগে কিছুই ছিলো না, এমন ভাবনা যেন বিজ্ঞানীরা অনেকটা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন কয়েক দশক ধরে। মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে অনেকে আবার বিগ-ব্যাং তথা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের মধ্যে একেবারে ‘ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি’ পর্যন্ত দেখতে পেয়েছিলেন। এমনকি নিউজ উইকের মত ম্যাগাজিন ১৯৯৮ সালের ২০ এ নভেম্বর সম্পাদকীয় ছেপেছিলো এই বলে বিজ্ঞান নাকি ঈশ্বরকে পেয়ে গেছে।
আসলে এই নিঃসীম নীরবতা ভেঙ্গে উত্তর হাজির হওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল আশির দশকে অ্যালেন গুথ নামে এক বিজ্ঞানীর আগমনের জন্য; ‘স্ফীতিতত্ত্বের জনক’ হিসেবে পরিচিত এই প্রতিভাধর বিজ্ঞানীর কাজের মাধ্যমেই এইসব কঠিন কঠিন প্রশ্নের উত্তর ক্রমশ আমরা জানতে পেরেছি।
স্ফীতি তত্ত্বের আবির্ভাব

আমাদের চিরচেনা মহাবিশ্ব এলো কোথা থেকে? এই প্রশ্ন কেউ করলে আমরা চোখ বুজে বলে দিই – কোত্থেকে আবার, ‘বিগ ব্যাং’ থেকে – বাংলায় আমরা যাকে ‘মহাবিস্ফোরণ’ নামে ডাকি। কিন্তু আশির দশকে ‘ইনফ্লেশন’ বা স্ফীতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজের কথা জানার পর থেকে কিন্তু বিজ্ঞানীরা এরকম উত্তর আর পছন্দ করছেন না। মহাবিশ্বের উদ্ভব বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ থেকে হয়েছে – এভাবে বললে হয়তো বলাই যায়, কিন্তু বিস্ফোরণের প্রকৃতি সম্বন্ধে আমরা কোন ধারণাই পাই না এ থেকে। অ্যালেন গুথের ভাষায়,
‘কী এই বিস্ফোরণ, কীভাবে এই বিস্ফোরণ, আর কেনই বা এই বিস্ফোরণ?'
আর বিগ ব্যাং-এর এর আগে কি ছিল এ ধরণের প্রশ্ন কিছুদিন আগেও বিজ্ঞানে দেখা হত ‘ব্লাসফেমি’ হিসেবে। আমরা আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বে যে স্থান কালের ধারণার সাথে পরিচিত, সেই স্থান ও কালের ধারণাও আসলে এসেছে এই মহাবিস্ফোরণ ঘটবার পর-মুহূর্ত থেকেই। কাজেই মহাবিস্ফোরণ ঘটার মুহূর্তে কিংবা পূর্বে কি ছিল- এ প্রশ্ন বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একেবারেই অর্থহীন।
কিন্তু অর্থহীন বলে সবাই এড়িয়ে গেলেও ‘ক্যারা মাথা’র কেউ কেউ থাকেন দুনিয়ায়, যারা ‘মান্য করে ধন্য’ হবার নন। তারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন না। নাফরমানি চিন্তা করতেই থাকেন অনবরত। এমনি একজন নাফরমান বিজ্ঞানী অ্যালেন গুথ।
অ্যালেন গুথ

গুথের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। না – হয়েল, গ্যামো, ওয়েইনবার্গ, হকিংদের মত প্রথম থেকেই একাডেমিয়ার সাথে যুক্ত কোন বিজ্ঞানী ছিলেন না গুথ। তার পরিচিতি বলার মত কিছু ছিল না, অন্তত আশির দশকের আগ পর্যন্ত তো বটেই। ১৯৭৯ সালে ৩২ বছরের এই বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ কাজ করছিলেন স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার এক্সিলেটরে, একজন ছাপোষা বিজ্ঞানের কর্মী হিসেবেই। চাকরি থাকা আর না থাকার মাঝামাঝি জায়গাতেও চলে গিয়েছিলেন কিছুদিন। হয়তো বা বিস্তৃতির আড়ালেই হারিয়ে যেতেন তিনি, কিন্তু সে অবস্থা থেকেই এমন এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করলেন, যে গোটা মহাবিশ্বের ছবিটাই গেল পালটে। মহাবিশ্বের পাশাপাশি অবশ্য তার জীবনও পাল্টালো বলাই বাহুল্য। অভূতপূর্ব এই আবিষ্কার মূলধারার বিজ্ঞানীদের মধ্যে এতোটাই সাড়া ফেলে দিল যে, এক মাসের মধ্যে তিনি আমেরিকার সাত সাতটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব পেলেন। এর মধ্যে থেকে তিনি গ্রহণ করলেন তার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটির অফার, এবং এখনো সেখানেই অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। তার সেসময়ের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটিকে এখন ইনফ্লেশন বা স্ফীতি-তত্ত্ব হিসেবে অভিহিত করা হয়। মহাবিশ্বের উদ্ভব বিষয়ক আধুনিক যে কোন বইয়ে কিংবা যে কোন পেপারে গুথের কাজের উল্লেখ না থাকলেই নয়। প্রমিত মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বকে এর সাথে জুড়ে দিয়ে তত্ত্বটিকে এখন ‘ইনফ্লেশনারি বিগ ব্যাং মডেল’ হিসেবেও ডাকা হয়। এততুকুর জন্য গুথকে চিন্তা করতে হয়েছিল এক ধরণের অস্থায়ী ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতার, যার নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘ফল্‌স্‌ ভ্যাকুয়াম’।
মহাবিশ্বের আকার

আমাদের মহাবিশ্ব যে বড় তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ঠিক কতটা বড়? আমাদের জানা শোনা বস্তুকণার মধ্যে আলোর বেগ সবচেয়ে বেশি। সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল। কিন্তু মহাবিশ্বের পুরোটুকু দেখতে চাইলে এই দানবীয় গতিবেগও নেহাত তুচ্ছ মনে হবে। আমাদের ছায়াপথ থেকে সবচেয়ে কাছের যে গ্যালাক্সি – অ্যান্ড্রোমিডা – সে রয়েছে ২০ লাখ আলোকবর্ষ দূরে। সবচেয়ে দূরবর্তী যে গ্যালাক্সিগুলো টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখা যায় সেগুলোর আলো ছড়িয়ে পড়েছিল ১৩ বিলিয়ন অর্থাৎ ১৩০০ কোটি বছর আগে। স্ফীতি টিতি নিয়ে যদি আমরা মাথা না ঘামাতাম, তবে ঐ ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষের দূরত্বকেই আমরা দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রান্তসীমা বলে ভাবতাম। বিগ ব্যাং তো হয়েছিল প্রায় ১৩০০ কোটি বছরের কাছাকাছি সময়েই। তাই ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষের চেয়ে বেশি দূরের জিনিস দেখা যাবেই বা কিভাবে?
কিন্তু দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রান্তসীমা ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষ নয়, বরং অন্তত ৪৬০০ কোটি আলোকবর্ষ। মানে, ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষের ঢের বেশি দূরের জিনিস বিজ্ঞানীরা ‘দেখতে’ পান। কারণ স্ফীতি তত্ত্বের কল্যাণে বিজ্ঞানীরা জানেন ১৩০০ কোটি বছর আগে যে গ্যালাক্সিগুলো থেকে আলো ছড়িয়ে পড়েছিল, সেগুলো আমাদের কাছ থেকে আলোর গতির দ্বিগুণ গতিতে দূরে চলে গেছে। ফলে মধ্যবর্তী স্থানের বিস্তর প্রসারণ ঘটেছে। আর দৃশ্যমান মহাবিশ্বের দেওয়ালটা সরে গিয়ে ৪৬০০ কোটি আলোকবর্ষের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ দুই পাশ হিসেব করলে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস হবে ৯২০০ কোটি আলোকবর্ষ।
আমাদের মহাবিশ্ব এতো বড় হল কীভাবে বিগ ব্যাং মডেলের জন্য সবসময়ই একটা সমস্যা। দৃশ্যমান মহাবিশ্ব প্রকৃত মহাবিশ্বের তুলনায় অনেক ছোট, আর আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি তো তার তুলনায় বিন্দুসম।
এত গেল ‘দৃশ্যমান’ মহাবিশ্বের কথা। প্রকৃত মহাবিশ্ব যে কত বড় কেউ তা জানে না। আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের দেওয়ালও তার কাছে ক্ষুদ্র। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বলছে মহাবিশ্বের ব্যাস অন্তত ১৫ হাজার কোটি আলোকবর্ষের কম হবে না।
মনোপোল সমস্যা
বিগ ব্যাং তত্ত্বের একটা ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, আমাদের মহাবিশ্বে বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয় আধানযুক্ত অতি ভারী একক মেরুবিশিষ্ট কিছু কণিকার প্রাচুর্য থাকবে। এই একক কণাগুলোকে বলা হয় মনোপোল। সহজ কথায় মনোপোল হচ্ছে সেরকম চুম্বক, যার কেবল উত্তর মেরু আছে, কিন্তু দক্ষিণ মেরু নেই; কিংবা হয়ত দক্ষিণ মেরু আছে, উত্তর মেরু নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ধরণের কোন কণার অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাই না।
একটা চুম্বক হাতে নিয়ে একে মাঝামাঝি জায়গায় দ্বিখণ্ডিত করুন। যে ছোট টুকরো দুটো পাওয়া যাবে, তাতে উত্তর আর দক্ষিণ মেরু থাকবে। সেগুলোকে দ্বিখণ্ডিত করলেও উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু বিশিষ্ট খণ্ড পাওয়া যাবে। যত ছোট টুকরাই আমরা করি না কেন, দেখব সব সময়ই উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুকে যুগল আকারেই পাওয়া যাচ্ছে। একক কোন উত্তর মেরু বা দক্ষিণ মেরু আমরা পাই না।
অথচ, গ্র্যাণ্ড ইউনিফাইড তত্ত্বের জোরালো পূর্বাভাস ছিল যে এ ধরণের কণা থাকতে হবে। তাহলে কেন আমরা সেগুলো দেখতে পাইনা? এই ব্যাপারটারও সমাধান হিসেবে হাজির হল স্ফীতিতত্ত্ব। ‘মনোপোল সমস্যার কথাই ধরুন। আদি মহাবিশ্বে এই মনোপোল প্রচুর পরিমাণে তৈরি হয়েছিল। এখন চিন্তা করুন, মনোপোল তৈরির আগেই ইনফ্লেশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এর ফলে ইনফ্লেশন যতক্ষণ টিকে থাকবে, আনুষঙ্গিক স্থান প্রসারিত হবে এত দ্রুতগতিতে যে মনোপোলগুলো লঘূকৃত হতে হতে শূন্যতায় মিলিয়ে যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত ডার্ক সুপার এনার্জি  অবক্ষয়িত হয়ে পদার্থে পরিণত হবে, এবং তেজস্ক্রিয়তা আর কোন মনোপোল তৈরি করবে না।
সাফল্য এবং প্রতিক্রিয়া
গুথের গবেষণার ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রকাশিত হলেও প্রাথমিকভাবে গুথ একটু ভীত ছিলেন এই ভেবে যে, হয়তো তার গণনায় কোথাও হয়ত ভুলত্রুটি আছে। বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা এর মধ্যেই তত্ত্বের ভুল বের করে ফেলবেন, এবং তিনি তার সহকর্মীদের মাঝে ঠাট্টা তামাসার পাত্র হয়ে উঠবেন।
তা অবশ্য হল না। আশির দশকে গুথ যখন তার নতুন তত্ত্ব নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করেছিলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী মারে গেল-ম্যান উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘আপনি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটির সমাধান করে ফেলেছেন’। এম আইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালেন পি লাইটম্যান তাঁর ধারণাটিকে অভিহিত করেছেন, ‘বিগ ব্যাং এর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাজাগতিক ধারণার উন্নয়ন’ হিসেবে। আরেক নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী শেল্ডন গ্ল্যাসো গুথের কাছে এসে বললেন,
‘গুথ, স্টিভেন ওয়েইবার্গ কিন্তু ইনফ্লেশনের কথা শুনে খুব রেগে গেছেন’।
-‘তাই নাকি? স্টিভ কি কোন সমস্যা খুঁজে পেয়েছেন?’
– উদ্বিগ্ন গুথ প্রশ্ন করলেন গ্ল্যাসো কে। গ্ল্যাসোর সাথেই পদার্থবিজ্ঞানে ভাগাভাগি করে নোবেল পেয়েছিলেন ওয়েনবার্গ। তাই স্টিভেন ওয়েনবার্গ কোন সমস্যা খুঁজে পেলে তা নির্ঘাত বিপদের কথা, জানতেন গুথ।
-‘ নাহ!’
আস্বস্ত করলেন গ্ল্যাসো –
‘এই স্ফীতির ব্যাপারটা তার নিজের মাথায় আসেনি কেন, এ নিয়ে ক্ষুব্ধ স্টিভ!’
নাহ, স্ফীতিতত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে কোন সমস্যা তৈরি করল না, বরং বড় ধরনের আলোড়নই ফেলে দিল বিজ্ঞানীদের মাঝে। মূলধারার বিজ্ঞানীরা স্ফীতি তত্ত্বকে সাদরেই গ্রহণ করলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তী কয়েক বছর ধরে স্ফীতি নিয়ে গবেষণাপত্রের লাগাতার প্রকাশে। একটা সময় গুথ হিসেব করতে বসেছিলেন কয়টা পেপারে স্ফীতিতত্ত্বের উল্লেখ আছে। প্রথম বছরই অন্তত ৪০ টি পেপারে গুথের কাজের উল্লেখ থাকলো। তারপর থেকে যেন এটা বাড়তে লাগল প্রায় গুণোত্তর হারেই। ১৯৯৭ সালে তার বিখ্যাত ‘দ্য ইনফ্লেশনারি ইউনিভার্স’ বইটি লেখার আগ পর্যন্ত হিসেব করে দেখেছিলেন অন্তত ৩০০০টা পেপারে ইনফ্লেশন নিয়ে গবেষণার হদিস আছে; তারপর গোনাগুনি ছেড়ে দিয়েছিলেন গুথ। এক অখ্যাত অচেনা টিউন ডক্টরেট ফেলো থেকে রাতারাতি পরিণত হলেন এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকে; পরিণত হলেন মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একজন শীর্ষস্থানীয় কাণ্ডারিতে।
এরপর যতদিন গেছে স্ফীতিতত্ত্ব কেবল জোরালো থেকে জোরালই হয়ে উঠেছে কেবল। যত দিন যাচ্ছে স্ফীতিতত্ত্বে পক্ষে প্রমাণের পাহাড় কেবল বাড়ছেই। স্ফীতিতত্ত্ব কেবল বিগ ব্যাং-এর মনোপোল, দিগন্ত বা সামতলিক সমস্যা জাতীয় সমস্যাগুলোই সমাধান করেনি, দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। একটি হল, মহাবিশ্বের জ্যামিতি হতে হবে সামতলিক, অর্থাৎ ওমেগা (Ω)-র মান হবে ১ এর একদম কাছাকাছি। আর দ্বিতীয়টি হল, আদি মহাবিশ্বের সঠিক ছবি কেউ তুলতে পারলে সেখানে কিছু বিশেষ প্যাটার্নে ঘনত্বের পার্থক্য বা ফ্লাকচুয়েশন পাওয়া যাবে। দুটোই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। ২০১৩ সালে ‘স্কাই এন্ড টেলিস্কোপ’ ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী এন্থনি এগুরি বলেন,
‘দুটো ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতাই নির্ণীত হয়েছে নাসার উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ অ্যানিসোট্রপি প্রোব স্যাটেলাই্টের পাঠানো উপাত্তের মাধ্যমে। স্ফীতিতত্ত্ব উত্তীর্ণ হয়েছে সময় সময় এ ধরনের বিভিন্ন পর্যবেক্ষিত পরীক্ষার মাধ্যমে খুব দুরন্তভাবেই। স্ফীতির যে প্রসারণের কথা আমরা বলি সেটা বোধহয় সত্যই ঘটেছিল।
স্ফীতি তত্ত্বের বিবর্তন
১৯৮১ সালে দেওয়া অ্যালেন গুথের স্ফীতিতত্ত্ব বিজ্ঞানীরা খুব সাদরে গ্রহণ করলেও মূল ভাষ্যে একটা ছোট সমস্যা ছিল। গুথ স্ফীতির শুরুটা কীভাবে ঘটবে সেটা বুঝতে পারলেও এর সমাপ্তি কীভাবে ঘটবে সেটার সুরাহা তিনি করতে পারছিলেন না। আসলে সমস্যাটা করেছিল প্রকৃত ভ্যাকুয়ামে উত্তরণের সময় মেকি ভ্যাকুয়ামের অবক্ষয়। গুথ দেখছিলেন, এই মেকি ভ্যাকুয়ামের অবক্ষয়ের ফলে অসংখ্য বুদ্বুদ তৈরি হয়। অনেকটা একটা পাত্রে পানি নিয়ে চুলায় ফুটাতে থাকলে আমরা যেমন দেখি, অনেকটা সেরকমের। কিন্তু গুথের মডেলে পাওয়া বুদ্বুদগুলো ছিল মহা বদ খদ। তারা একে অপরের সাথে সংঘর্ষ ঘটিয়ে অতি দ্রুত এমন ‘ভ্যারাচ্যারা অবস্থা’ তৈরি করে যে মহাবিশ্বের সমসত্ত্ব অবস্থার একেবারে বারোটা বেজে যায়। অর্থাৎ গুথের মূল মডেল সত্য হলে মহাবিশ্ব আজকের দিনের মত এত সুষম হবার কথা নয়। কাজেই কোথাও একটা ঝামেলা আছে। এই ঝামেলার ব্যাপারটা অবশ্য গুথের নিজেরই নজরে পড়েছিল। সেই সাথে পড়েছিল আরেক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর অভিজ্ঞ চোখেও। হকিং একটু ভিন্ন দিক থেকে গণনা করে সিদ্ধান্তে এলেন, বুদ্বুদগুলোর সংঘর্ষ কোন সমস্যা করবে না, কিন্তু বুদ্বুদগুলোর তুলনায় মহাবিশ্ব এত দ্রুত প্রসারিত হবে যে কোন ধরণের সংঘর্ষ ঘটারই সুযোগ পাবে না, আর সেটা মহাবিশ্বকে এক সময় পরিণত করবে এক ‘এম্পটি ইউনিভার্স’ এ; এর কোন কোন জায়গায় প্রতিসাম্যতার ভাঙ্গন ঘটবে, কোন কোন জায়গা থেকে যাবে অক্ষত। এই মহাবিশ্ব মোটাদাগে পরিণত হবে সমরূপতা বিবর্জিত এক মহাবিশ্বে যা মোটেই আমাদের আজকের মহাবিশ্বের মতো নয়। কাজেই গুথের ‘পুরাতন’ এ স্ফীতিতত্ত্ব অনুযায়ী হয় বুদবুদের স্থানান্তর ঘটবে এত দ্রুত যে যথেষ্ট স্ফীতি ঘটার সুযোগ থাকবে না, আর নয়তো এত ধীরে এগুবে যে, মহাবিশ্ব স্ফীতি থেকে বেরুতেই পারবে না। এই সমস্যাটিকে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘মার্জিত নির্গমন সমস্যা’ হিসেবে।
পদার্থের উৎপত্তি
বিংশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত মহাবিশ্ব উৎপত্তিতে যে একটি বা বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার প্রয়োজন ছিল তা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত মানতেন। আমরা জানি মহাবিশ্ব বিপুল পরিমাণ পদার্থ দিয়ে গঠিত। আর পদার্থের ধর্ম হল এর ভর। বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত ধারণা করা হতো, ভরের সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, এটি শুধু এক রূপ থেকে আরেকরূপে পরিবর্তিত হয়। শক্তির নিত্যতার সূত্রের মতো এটি ভরের নিত্যতার সূত্র। সুতরাং এই বিপুল পরিমাণ ভর দেখে সবাই ধারণা করে নিয়েছিলেন একদম শুরুতে ভর সৃষ্টি হবার মতো অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল, যা সরাসরি ভরের নিত্যতার সূত্রের লঙ্ঘন।
পদার্থের অনেক সংজ্ঞা আমরা জানি। আমার কাছে এর সবচেয়ে দুর্দান্ত ও সহজ সংজ্ঞা হলো- পদার্থ এমন একটি জিনিস যাকে ধাক্কা মারা হলে এটি পাল্টা ধাক্কা মারে। কোনো বস্তুর মধ্যকার পদার্থের পরিমাপ করা যায় এর ভরের সাহায্যে। একটি বস্তুর ভর যতো বেশি তাকে ধাক্কা মারা হলে ফিরিয়ে দেওয়া ধাক্কার শক্তি তত বেশি। বস্তু যখন চলা শুরু করে তখন সেই চলাটাকে বর্ণনা করা হয় ভরবেগ বা মোমেন্টামের মাধ্যমে, যা বস্তুর ভর ও বস্তুর যে গতিতে চলছে তার গুণফলের সমান। মোমেন্টাম বা ভরবেগ একটি ভেক্টর রাশি, এর দিক ও বস্তুর গতির দিক একই।
ভর এবং মোমেন্টাম দুইটি জিনিসই পদার্থের আরেকটি ধর্মকে যথাযথ ভাবে সমর্থন করে যাকে আমরা বলি ইনারশিয়া বা জড়তা। একটি বস্তুর ভর যত বেশি তত এটিকে নাড়ানো কঠিন এবং এটি নড়তে থাকলে সেটাকে থামানো কঠিন। একই সাথে বস্তুর মোমেন্টাম যত বেশি তত একে থামানো কষ্ট, থেমে থাকলে চালাতে কষ্ট। অর্থাৎ বেশি পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন।
বস্তুর গতির আরেকটি পরিমাপযোগ্য ধর্ম হলো এর শক্তি। শক্তি, ভর ও মোমেন্টাম থেকে স্বাধীন কোনো ব্যাপার না, এই তিনটি একই সাথে সম্পর্কিত। তিনটির মধ্যে দুইটির মান জানা থাকলে অপরটি গাণিতিকভাবে বের করা সম্ভব। ভর, মোমেন্টাম এবং শক্তি এই তিনটি রাশি দিয়ে আমরা একটি সমকোণী ত্রিভুজ আঁকতে পারি। সমকোণী ত্রিভুজটির লম্ব হলো মোমেন্টাম p, ভূমি ভর m আর অতিভুজ শক্তি E। এখন পিথাগোরাসের উপপাদ্য ব্যবহার করে এই তিনটির সম্পর্ক নির্ণয় করা যায়।
শক্তির নিত্যতা সূত্র বা তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র অনুযায়ী আমরা জানি শক্তিকে অন্য কোথাও থেকে আসতে হবে। আমরা ধর্মীয় অলৌকিকতার প্রমাণ পেতাম যদি কেউ দেখাতো যে আজ থেকে তেরোশ কোটি বছর আগে বিগব্যাং-এর শুরুতে শক্তির নিত্যতার সূত্রের লঙ্ঘন ঘটেছিল, আর ঈশ্বর বা কোন অপার্থিব সত্ত্বার হাত ছাড়া উৎপত্তির আর কোন ব্যাখ্যা নেই।
কিন্তু পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মোটেও ব্যাপারটি এমন নয়। তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র অনুযায়ী একটি বদ্ধ সিস্টেমে মোট শক্তির পরিমাপ স্থির থাকলেই কেবল শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। মজার এবং আসলেই দারুণ মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ শূন্য! বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তার ১৯৮৮ এর সর্বাধিক বিক্রিত বই, ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’-এ উল্লেখ করেছেন, যদি এমন একটা মহাবিশ্ব ধরে নেওয়া যায়, যেটা মহাশূন্যে মোটামুটি সমসত্ত্ব, তাহলে দেখানো সম্ভব, যে ঋণাত্মক মহাকর্ষীয় শক্তি এবং ধনাত্মক মহাকর্ষীয় শক্তি ঠিক ঠিক কাটাকাটি যায়। তাই মহাবিশ্বের মোট শক্তি থাকে শূন্য। বিশেষ করে, পরিমাপের অতি সূক্ষ্ম বিচ্যুতি ধরে নিলেও, ক্ষুদ্র কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তার মধ্যে, মহাবিশ্বের গড় শক্তির ঘনত্ব ঠিক ততটাই দেখা যায়, যতটা হতো সবকিছু একটা শূন্য শক্তির আদি অবস্থা থেকে শুরু হলে।
প্রাকৃতিক উপায়ে মহাবিশ্বের সূচনা
প্রাকৃতিক উপায়ে অর্থাৎ, ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে শূন্য থেকে মহাবিশ্ব থেকে উৎপন্ন হতে পারে এ ধারণাটি যে এডওয়ার্ড ট্রিয়ন ১৯৭৩ সালে ব্যক্ত করেছিলেন। ট্রিয়ন বলেছিলেন,
‘আমি এক্ষেত্রে একটা বিনয়ী প্রস্তাবনা হাজির করতে চাই যে, আমাদের মহাবিশ্ব হচ্ছে এমন একটি জিনিস যেটা কিনা সময় সময় উদ্ভূত হয়’।
তবে ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত ‘ইজ দ্য ইউনিভার্স এ ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন’ শিরোনামের সেই প্রবন্ধে যে ভাবে মহাবিশ্ব উৎপত্তি হয়েছে বলে ট্রিয়ন ধারণা করেছিলেন, তাতে কিছু সমস্যা ছিল। প্রথমত: এই প্রক্রিয়ায় ১৪০০ কোটি বছর আগেকার পৃথিবীর উদ্ভবের সম্ভাবনাটি খুবই কম। কারণ ফ্লাকচুয়েশনগুলো সাধারণত হয় খুবই অস্থায়ী। সে হিসেবে একটি ফ্লাকচুয়েশন প্রায় ১৪০০ কোটি বছর টিকে থাকার সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব ব্যাপারই বলতে হবে। আসলে ফ্লাকচুয়েশনের স্থায়িত্ব বা জীবনকাল নির্ভর করে এর ভরের উপর। ভর যত বড় হবে, ফ্লাকচুয়েশনের জীবনীকাল তত কম হবে। দেখা গেছে একটি ফ্লাকচুয়েশনকে তেরশ কোটি বছর টিকে থাকতে হলে এর ভর ১০-৬৫ গ্রামের চেয়েও ছোট হতে হবে, যা একটি ইলেকট্রনের ভরের ১০৩৮ গুণ ছোট। আর দ্বিতীয়ত: এই মহাবিশ্ব যদি শূন্যাবস্থা (empty space) থেকে উৎপত্তি হয়ে থাকে, তবে প্রশ্ন থেকে যায়- আদিতে সেই শূন্যাবস্থাই বা এলো কোথা থেকে (আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী, স্পেস বা শূন্যাবস্থাকে দেশকালের বক্রতার পরিমাপে প্রকাশ করা হয়)। প্রথম সমস্যাটির সমাধান ট্রিয়ন নিজেই দিয়েছিলেন। ট্রিয়ন আপেক্ষিকতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ দলের (যেমন পদার্থবিদ পিটার বার্গম্যান) সাথে সে সময়ই আলোচনা করে বুঝেছিলেন, একটি আবদ্ধ মহাবিশ্বে ঋণাত্মক মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ধনাত্মক ভর শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। অর্থাৎ মহাবিশ্বে মোটশক্তির পরিমাণ (এবং এই শক্তির সমতুল্য পদার্থের পরিমাণ) শূন্য। সে হিসেবে প্রায় ভরশূন্য অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করলে একটি ফ্লাকচুয়েশন প্রায় অসীমকাল টিকে থাকবে।
১৯৮২ সালে আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিন (Alexander Vilenkin) দ্বিতীয় সমস্যাটির একটি সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেন এভাবে – মহাবিশ্ব সৃষ্ট হয়েছে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ‘শূন্য’ থেকে – তবে এই শূন্যাবস্থা শুধু ‘পদার্থবিহীন’ শূন্যাবস্থা নয়, বরং সেইসাথে সময়শূন্যতা এবং স্থানশূন্যতাও বটে। ভিলেঙ্কিন কোয়ান্টাম টানেলিং এর ধারণাকে ট্রিয়নের এর তত্ত্বের সাথে জুড়ে দিয়ে বললেন, এ মহাবিশ্ব যাত্রা শুরু করেছে এক শূন্য জ্যামিতি (empty geometry) থেকে এবং কোয়ান্টাম টানেলিং এর মধ্য দিয়ে উত্তোরিত হয়েছে অশূন্য অবস্থায় (non-empty state) আর অবশেষে ইনফ্লেশনের মধ্য দিয়ে বেলুনের মত আকারে বেড়ে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
১৯৮১ সালে স্টিফেন হকিং এবং জেমস হার্টলি ভিন্নভাবে সমস্যাটির সমাধান করেন। তাদের মডেল পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ‘প্রান্তহীন প্রস্তাবনা’ (no-boundary proposal) হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তাদের মডেলটি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী রিচার্ড ফেইনমেনের বিখ্যাত ইতিহাসের যোগ বা ‘sum over histories’ এর উপর ভিত্তি করে তৈরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফেইনমেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখিয়েছিলেন, একটি কণার কেবল একটি ইতিহাস থাকে না, থাকে বিভিন্ন সম্ভাব্য হিস্ট্রির সমাহার, অর্থাৎ গাণিতিকভাবে – অসংখ্য সম্ভাবনার অপেক্ষকের সমষ্টি। আমরা কণার দ্বিচিড় বা ডবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট সহ বহু বিখ্যাত পরীক্ষা থেকে ব্যাপারটার সত্যতা জেনেছি। ঠিক একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে হকিং দেখিয়েছেন যে, এই ব্যাপারটা আমাদের মহাবিশ্বের জন্যও একইভাবে সত্য। হকিং ইতিহাসের যোগসূত্র প্রয়োগ করতে গিয়ে আরো দেখলেন স্থান এবং কালের পুরো ব্যাপারটা প্রান্তবিহীন সসীম আকারের বদ্ধ গোলকীয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়ে যায়। ব্যাপারটা যেন অনেকটা পৃথিবীর সাথে তুলনীয়। আমরা জানি, পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশও আকারে সসীম, কিন্তু প্রান্তবিহীন গোলকের মত। গোলকের কোন প্রান্ত থাকে না। সেজন্যই দক্ষিণ মেরুর ১ মাইল দক্ষিণে কি আছে তা বলার অর্থ হয় না। হকিং এর দৃষ্টিতে মহাবিশ্বের আদি অবস্থাটাও তেমনি।
এখানে মূল ব্যাপারটি হল, হকিং এর মডেলটিও ভিলেঙ্কিনের মডেলের মতো প্রাকৃতিকভাবে মহাবিশ্বের উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করতে পারে। তবে হকিং-হার্টলি মডেলের সাথে ভিলেঙ্কিনের মডেলের পার্থক্য হল, এই মডেলে ভিলেঙ্কিনের মতো ‘পরম শূন্য’-এর ধারণা গ্রহণ করার দরকার নেই।
বার্টরাণ্ড রাসেল

নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক বার্টরাণ্ড রাসেলকে নিয়ে একটি চমৎকার গল্প প্রচলিত আছে। তিনি একবার সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত এক সেমিনারে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সূর্যকে কেন্দ্র করে কীভাবে পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহমণ্ডল ঘুরছে, এবং সূর্য আবার কীভাবে আমাদের ছায়াপথে ঘুরছে এগুলোই ছিল বক্তৃতার বিষয়। বক্তৃতা শেষ হল এক বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘এতক্ষণ তুমি যা যা বলেছ তা সব বাজে কথা। পৃথিবী আসলে সমতল, আর সেটা রয়েছে একটা বিরাট কচ্ছপের উপর।
রাসেল মৃদু হেসে বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘কচ্ছপটা তাহলে কার উপর দাঁড়িয়ে আছে?’
বৃদ্ধা খানিকক্ষণ ভেবে জবাব দিলেন,
‘ছোকরা, তুমি খুব চালাক। তবে জেনে রাখ, কচ্ছপটার তলায় আরেকটা কচ্ছপ, আর ওটার তলায় আরেকটা – এভাবে পর পর সবই কচ্ছপ রয়েছে’। 
আইনস্টাইন ও এক গভীর সমস্যা
১৯২০ সালের দিকে আলবার্ট আইনস্টাইন এক গভীর সমস্যা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। সমস্যাটি মহাবিশ্বের প্রকৃতি এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে। তার মত বিজ্ঞানীর অবশ্য এসব সমস্যা নিয়ে খুব বেশি হাবুডুবু খাওয়ার কথা নয়। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব এবং আপেক্ষিকতার সাধারণ বা ব্যাপক তত্ত্ব দুইটিই বিজ্ঞানের জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অভিকর্ষ বলের প্রভাবে স্থান-কালের বক্রতা যে আলোর গতিকেও বাঁকিয়ে দিতে পারে, তা এডিংটনের পরীক্ষায় হাতে কলমে প্রমাণিত হয়ে গেছে ১৯১৯ সালের জুনের দুই তারিখে। যে বুধ গ্রহের বিচলন নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ নিয়ম দিয়ে কোনভাবেই মেলানো যাচ্ছিল না, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকত তত্ত্ব সংক্রান্ত গণনার ছাঁচে ফেলে খাপে খাপ মিলিয়ে দেয়া গেছে। আইনস্টাইন তখন নিজেই রীতিমত এক তারকা।
আইনস্টাইন চাইলে এ সময় একটু সাহসী হতে পারতেন। তার তত্ত্ব থেকেই কিন্তু বেরিয়ে আসতে শুরু করেছিল যে আমাদের মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে, মানে আকাশের যাবতীয় গ্রহ নক্ষত্র তারকা, গ্যালাক্সিরা সব একে অন্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু আইনস্টাইন নিজেই সেটা বুঝতে পারলেন না। বুঝতে পারলেন না বলাটা বোধ হয় ঠিক হল না। বলা উচিৎ মানতে চাইলেন না। মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে গ্যালাক্সিগুলোর একে অন্যের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি তার গাণিতিক সমীকরণে একটা কাল্পনিক ধ্রুবক যোগ করে দিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এতে করে মহাবিশ্ব চুপসে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ভারসাম্য বা স্থিতাবস্থা প্রাপ্ত হবে। এটাই সেই বিখ্যাত ‘মহাজাগিতিক ধ্রুবক’, গ্রীক অক্ষর ল্যামডা দিয়ে নাম করে স্থিতিশীল মহাবিশ্বের মডেলের প্রতি আস্থা স্থাপন করেছিলেন আইনস্টাইন। এই ধরণের মহাবিশ্ব সংকুচিতও হয় না প্রসারিতও হয় না। সে সময় অধিকাংশ পদার্থবিজ্ঞানীরাই মহাবিশ্বকে এভাবে দেখতেন। কিন্তু সবাই দেখলেই আইনস্টাইনকে দেখতে হবে কেন? বহুক্ষেত্রেই তো চিন্তায় চেতনায় তিনি বিপ্লবী। নিউটনের চীরচেনা পরম মহাবিশ্বের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে বানিয়েছিলেন আপেক্ষিকতার এক নতুন জগৎ। অথচ মহাবিশ্বের প্রসারণের বেলায় তিনি ঝাঁকের কই হয়েই রইলেন কেন যেন।
এর প্রায় বারো বছর পর আমেরিকান জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী এডউইন হাবল যখন টেলিস্কোপের সাহায্যে চাক্ষুষ প্রমাণ হাজির করলেন, দেখিয়ে দিলেন যে, মহাবিশ্ব স্থিতিশীল মোটেই নয়, বরং সত্যই প্রসারিত হচ্ছে, তখন আইনস্টাইন মুখ কাচুমাচু করে স্বীকার করে নিলেন যে, সমীকরণের মধ্যে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক বসানোটা ‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’ ছিল।
যে আইনস্টাইন সবসময়ই স্থবিরতাকে চ্যালেঞ্জ করেছন সারা জীবন ধরে, সেখানে তিনি কেন স্থবির মহাবিশ্বকে সত্য বলে ভেবে নিয়েছিনে তা আমাদের রীতিমত বিস্মিত করে। বিস্মিত করেছিল প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক জেমস পিবলসকেও। তিনি বলেন, ‘স্ট্যাটিক মহাবিশ্ব তো কাঠামোগতভাবেই স্বসঙ্গতিপূর্ণ নয়। সূর্য তো সারা জীবন ধরে জ্বলে থাকতে পারে না। এ ব্যাপারটা আইনস্টাইন বুঝতে পারেননি, এটা আমাকে অবাক করে দেয়, এখনো’।
অবশ্য কে তখন জানতো আইনস্টাইনের ভুল তো আর যে সে ভুল নয়! তার সমীকরণে যে মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের আমদানীকে ‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন তিনি নিজে, সেই ভুলই আবার সিন্দাবাদের ভুতের মতো কাঁধে সওয়ার হয়ে ফিরে এসেছে নতুন উদ্যমে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে।


Written By: Abu Hasan Rumi                Source: Techtunes
মহাবিশ্ব ও বিগ ব্যাং তত্ত্ব রিভিউ করছেন Unknown তে 1:01 PM রেটিং:

No comments:

কপিরাইট ২০১৬ © টিপস ওয়ার্ল্ড এর সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ডিজাইন করেছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন

যোগাযোগ

Name

Email *

Message *

Theme images by enot-poloskun. Powered by Blogger.